ঢাকা শহরে বর্তমানে ফ্ল্যাট কেনা নাকি বাড়ি বানানো অধিক লাভজনক?
Posted on: 2021-05-23 14:07:25 | Posted by: kakolifurniture
প্রতিটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং একেকটা বস্তি। ইংল্যান্ডের কোন এক যুবরাজ যেন এরকম একটি কথা বলেছিলেন আরও ২০/২২ বছর আগে। কথাটা তখন হাসান সাহেব অতটা বুঝতেন না। তবে ফ্লাট তার কাছে কেমন যেন ভাড়া বাড়ীর মত মনে হতো। কাজেই মিশনে বেশ কিছু ডলার কামাই করার সুবাদে সামান্য সামর্থ্য হয়ে গেলেও ফ্লাট কেনায় উৎসাহ দেখাননি কখনো। যদিও এখনকার তুলনায় তখন প্রায় পানির দরেই ফ্লাটগুলো বিক্রি হচ্ছিল।
তার মিসেসও তার মতই ভাবতো এবং বেশ ফ্লাট বিরোধী মনোভাবই পোষণ করতেন। যাহোক কি করা যায় কি করা যায় ভাবতে ভাবতে স্বনামধন্য দুটো প্রতিষ্ঠানে দুবারের মিশনে দুটো প্লট বুকিং দিয়ে দিলেন- একান্তই তার মিসেসের চাঁপা-চাপি আর প্ররোচনায়। তার একটি, খোদ রাজধানীতেট আর অন্যটি, তার মফস্বল এলাকায়। যদিও খুব অনিচ্ছায় কাজটা তাকে করতে হয়েছিল। তার ইচ্ছা ছিল ডলারগুলো দিয়ে আরও কিছু দেশ-টেশ ঘুরে ফিরে গায়ের জ্বালা জুড়াবেন। গায়ের জ্বালা মানে গা গরম, গা গরম মানে তার পকেটে টাকা থাকলে তিনি বেশ গরম বোধ করেন এবং যতক্ষণ তার একটা বিহিত ব্যবস্থা না করতে পারেন তার মাথা ঘুরতে থাকে।
এগুলো বেশ আগের কথা। তারপর কি? তারপর আর কি! খাই দাই, চাকরী-বাকরী করে তার আরও এক যুগ পেরিয়ে গেল। তার মিসেস যে দুটো এলাকায় প্লট দুটো রেখেছিলেন পত্র-পত্রিকার সে সব জায়গার সেল বিজ্ঞাপন দেখেই ক্রেতা সেজে ফোন করতে লাগলেন এবং দাম-টাম শুনে বুঝে গেলেন যে তিনি ক্রোরপতি বনে গেছেন।
এরপর? এরপর আর কি! সারা দিন হাসান সাহেবের সাথে ভ্যানর ভ্যানর, একটা প্লট ছেড়ে দিয়ে ফ্লাট কিনবেন। হাসান সাহেব বললেন একসময়-তো ফ্লাট তারা দুজনেই পছন্দ করতেন না। তিনি মিন মিন করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন অবসরে যেয়ে মফস্বলেরটা ছেড়ে সেটা দিয়ে ঢাকারটায় নিজেই কিছু একটা দাঁড় করে ফেলবেন। কিন্তু শুনলেন না রুমকি। যুক্তি দেখালেন ফ্লাট কিনেও বেশ ভাল একটা টাকা থেকে যাবে, তাছাড়া ওটা ডেভেলপারকে দিয়ে দিলেও ৭/৮ টা ফ্লাট পাওয়া যাবে। অবশেষে হাসান সাহেবই পরাজিত হলেন। তার মিসেসের পিছু পিছু ঘুরে মফঃস্বলের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে একটা ফ্লাট কিনেই ফেললেন।
প্রথমে জানা গেল, ল্যান্ডওনারের সাথে ডেভেলপারের ফ্লাটের অংশ ভাগা-ভাগি নিয়ে গোলযোগ চলছে, পরে জানা গেল গোলযোগ না, আসলে কোর্টে মামলা চলছে। এরপরে তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত জিডি পাল্টা জিডি। পুলিশ। আদালত। সালিশ আরও কতো কাহিনী। এসবের মধ্যেই বছর দুয়েক ঘুরে হাসান সাহেবরা কোনমতে ফ্লাটে উঠে গেলেন।
এবার পক্ষ তিনটি হয়ে গেল। ল্যান্ড ওনার, ফ্লাট ওনার আর ডেভেলপার। ডেভেলপার, ফ্লাট ওনার্স এসোসিয়েশন করে দিলেন। ল্যান্ড ওনার তা মানেন না। লিফট নষ্ট হলে, জেনারেটরের সার্ভিসিং লাগলে, বিল্ডিঙের কমন ইউটিলিটি বিল, দারোয়ানের বেতন ইত্যাদি এ'মাস দেনতো ওমাসে দেন না। ল্যান্ড ওনার আর তার সন্তানেরা হম্বি তম্বি করে বেড়ায় এমন ভাবে, যেন ফ্লাটওনার্সরা তাদের ভাড়াটিয়া।
এদিকে হাসান সাহেব দেখলেন ঢাকা শহরে এযাবৎ কাল ভাড়াটিয়া হিসেবে যে নিবিড় শান্তিতে বসবাস করেছেন তার কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। উপরন্ত ফ্লাট লালন পালনে ভাড়ার মতই প্রায় অর্ধেক টাকা গাঁট থেকে প্রতিমাসে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার পর আজ এ মিটিং কাল ও মিটিং। আজ এই শালিস তো কাল ফুলের টব ভাঙ্গার বিচার। হাসান সাহেব তখন অনেকের সাথে তার এই বিড়ম্বনা শেয়ার করতে যেয়ে বুঝলেন ঢাকার বেশিরভাগ ফ্লাটের মালিকের গল্পটা কম-বেশিই একইরকম।
সরোয়ার সাহেব হাসান সাহেবের ছাত্র জীবনের বন্ধু। তিনি ঢাকা শহর থেকে একটু দূরে গ্রামের লাগালাগি দু’বিঘা জমি কিনেছিলেন খুব বেশী দিন হয়নি। তিনি সেখানে অল্প খরচে দোতালা একটা ছিমছাম বাড়ী করেছেন। জমির চারিদিকে হাফ ওয়াল হাফ কাঁটা তারের বেড়া দিয়েছেন। নানা ধরনের ফল আর ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন। ছোট একটা পুকুর করে মাছ ছেড়েছেন। তার উপর সীমিত আকারে আবার হাস মুরগী পালেন। বিকেল হলে বাড়ীর ছাঁদে বসে তিনি তার মিসেস গল্প করেন। ছেলেটা দার্জিলিং থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়ে এসে ছোট একটা চাকরী করছে। ভাল কোন অফারের অপেক্ষায় আছে। সরোয়ার সাহেব নিজেই ড্রাইভ করে অফিসে যান। তিনি পেশায় একজন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক। ঢাবি থেকে তিনি আর তার মিসেস জার্নালিজমে পাশ করে দীর্ঘ দিন পত্রিকায় ভাল অবস্থানে চাকরী করেছেন।
হাসান সাহেব তার বন্ধু সরোয়ার সাহেবের কথা ভাবেন আর আফসোস করেন। কিছুই না, শুধু এই ফ্লাট কিনে ফেঁসে যাওয়ার আফসোস, লাভ না শান্তি কোনটাকে খুঁজবেন তা ঠিক সময়ে বুঝতে না পারার আফসোস। অজানা ভিন্ন ভিন্ন রুচির, ভিন্ন শিক্ষার, ভিন্ন ভিন্ন কৃষ্টির একুশটা পরিবারের সাথে প্রতিনিয়ত আপোষ-রফা করে বস্তিয় জীবনে বসবাসের আফসোস!
নিজের যে শান্তি তিনি নিজ হাতে গলা টিপে নষ্ট করেছেন তা ফিরিয়ে আনতে গেলে আবার নতুনভাবে শুরু করতে হবে। এতটুকু জীবনে এত যুদ্ধের মোকাবেলার সাহস তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে বিরচিত)