মুল পাতা

শহীদ মোহাম্মদ আল জাওয়ারী : হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের নেপথ্যে গল্প


Posted on: 2021-05-18 19:22:17 | Posted by: MD Bayzid


১৯৯১ সাল । তিউনিশিয়ায় তখন স্বৈরশাসক জয়নুল আবেদীন বেন আলীর শাসন চলছে । তার শাসনের বিরুদ্ধে সরব ছিলো ইসলামিস্ট দল আননাহদা । বেন আলীর বিপক্ষে স্টুডেন্ট এক্টিভিজম করতো এরকম ছাত্রদের সংখ্যা ছিলো বিশাল । তেমনই একজন ছাত্র ছিলেন সাফাকিসের মুহাম্মদ আল জাওয়ারী যিনি তিউনিশিয়ায় স্টুডেন্ট এক্টিভিজমের দায়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন ও পরে হয়ে ওঠেন হামাসের ড্রোন ইউনিটের মাস্টারমাইন্ড ।

.

.

১৯৬৭ সালে তিউনিশিয়ার সাফাকিসে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আল জাওয়ারী । স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই আন নাহদার পক্ষে এক্টিভিজম করতেন তিনি । তিনি ১৯৯১ সালে তৎকালীন বেন আলী সরকারের জুলুম থেকে বাচতে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন । এজন্য “মুরাদ” নামে আরেক নাগরিকের জাল পাসপোর্ট ম্যানেজ করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সবার কাছে মুরাদ নামেই পরিচিতি লাভ করেন । কিন্তু পাসপোর্টের মুরাদের ছবির সাথে উনার নূন্যতম মিল ছিলো না । মুরাদ ছিলো দেখতে অনেক স্থুল,গম্ভীর কিন্ত তিনি ছিলেন অনেক হালকা । ফলে তিনি যখন তিউনিশিয়া থেকে লিবিয়া বর্ডারে যান তখন অনেক গুলো কাপড় পরেন ও মুখে তুলা গুজে দেন যাতে তাকে দেখতে মোটা মনে হয় । ভাগ্যক্রমে তিনি তিউনিশিয়ার বর্ডারে ছাড়া পেয়ে যান ও লিবিয়ায় প্রবেশ করেন । লিবিয়া থেকে তিনি সরাসরি সুদানে চলে যান । সুদানে তখন ইসলামিস্ট ওমর আল বশির ক্ষমতায় থাকায় সুদান হয়ে ওঠেছিলো ইস্লামিস্টদের নিরাপদ আস্তানা । ওসামা বিন লাদেন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক নেতৃস্থানীয় ইস্লামিস্ট তখন সুদানে আশ্রয় নেয় ।

.

.

জাওয়ারী সুদানে কিছুদিন থাকার পর সেখানের নাগরিকত্ব লাভ করেন । সুদানে প্রথমে তিনি একটি কাঠ প্রস্তুতকারক ফ্যাক্টরিতে কাজ নেন ও সেখানকার যন্ত্রপাতি মেইন্টেন্যান্স করতেন । পরবর্তীতে সেনাবাহিনী সেই কাঠ প্রস্তুতকারক কোম্পানিকে কিনে নিলেও চাকরিতে বহাল থাকেন তিনি । ফলে সুদানি সেনাবাহিনীর অধীনের কিছুদিন কাজ করেন তিনি ।

.

.

সুদানে দীর্ঘদিন থাকার পর তিনি ইরাকে যান,ইরাক সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ এক অফিসারের সাথে পরিচিত হন ও ইরাকের প্রথম ড্রোন “এসএম” প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হন । ২০০৬ সালে তিনি সিরিয়াতে প্রবেশ করেন ও এখানেই প্রথম তিনি আল কাসসাম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত হন । আল কাসসাম ব্রিগেড তখন তাদের ড্রোন তৈরির প্রথম ধাপে ছিলো ।

.

.

২০০৮ এর ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের আগেই জাওয়ারীর নেতৃত্বে আল কাসসাম ব্রিগেডের একদল ইঞ্জিনিয়ার এভিয়েশন, কম্যুনিকেশন ,কমান্ড, ম্যানুফেকচার ও কন্ট্রোলের উপর তিন ধাপে ছয়মাসের প্রশিক্ষণ নিতে ইরান ভ্রমণ করেন ও প্রশিক্ষণ শেষে ইরানের ল্যাবেই ৩০ টি ড্রোন তৈরি করেন । ইরান ড্রোন প্রযুক্তিতে হামাসের অগ্রগতি দেখে অভিভূত হয় । সিরিয়া ও ইরানে সফলভাবে ড্রোন তৈরির পর আল কাসসাম ব্রিগেড তাকে গাযায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় কেননা গাযায় একই সময় ইঞ্জিনিয়ারদের আরেকটা দল “বুরাক” প্রজেক্ট নামে আরেকটা ড্রোন তৈরির জন্য কাজ করছিলো । দুইদলই যাতে পরস্পর কাজের সমন্বয় করতে পারে ও তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে “বুরাক” প্রজেক্ট শেষ করতে পারে সেই দায়িত্ব বর্তায় জাওয়ারীর কাধে । সুপারভাইজার হিসেবে জাওয়ারী খুবই সফলভাবে দুইদলের সমন্বয় করে প্রজেক্টটি সমাপ্ত করেন ।

.

.

২০১১ সালের আরব বসন্তে তিউনিশিয়ায় বেন আলীর পতন ঘটার পর তিনি প্রায় বিশ বছর পরে তিউনিশিয়ায় ফেরেন ও পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তার পড়াশোনা শেষ করার ব্যাপারে মনযোগী হন একই সাথে হামাসের জন্যও কাজ করা অব্যাহত রাখেন । তিনি সাফাকিস বিশ্ববিদ্যালয়ে এভিয়েশন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন ও সেই ক্লাবের ফান্ডিং তিনি নিজেই করতেন ।

.

.

২০১২ ও ১৩ সালের মধ্যে জাওয়ারী বেশ কয়েকবার গাযায় যান ও প্রায় নয়মাসের মতো গাযায় অবস্থান করেন । এ সময় তিনি আবাবিল ড্রোনের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন । ২০১৪ সালের ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে প্রথমবারের মতো আবাবিল ড্রোন ব্যবহার করে হামাস ।

.

.

১৫ ডিসেম্বর,২০১৬ সালে দুপুর ১.৫০ এর দিকে তিনি বাসা থেকে কার নিয়ে বের হলে একটি ট্রাক তার কারের গতি রোধ করে ও দুইজন অপরিচিত বন্দুকধারী সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে প্রায় বিশটি গুলি ছুড়ে । এর মধ্যে ৩টি গুলি সরাসরি তার বুকে বিদ্ধ হলে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন ।

.

.

তার মৃত্যুর দুইদিন পর হামাস তাকে আল কাসসাম ব্রিগেডের সদস্য বলে স্বীকার করলে হামাসের সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে আসে । তিনি দ্বৈত জীবনযাপন করতেন ও এতই গোপনীয়তা রক্ষা করতেন যে হামাস সম্পৃক্ততার বিষয়টি তার স্ত্রীও জানতো না্ । হামাস তাকে হত্যার জন্য ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে দায়ী করে ।

(সংযুক্তি : প্রথম ছবিতে গাযা উপত্যকায় কন্ট্রোলার হাতে আবাবিল ড্রোনের উড্ডয়ন পরীক্ষা করছেন তিনি ।

দ্বিতীয় ছবিতে শাহাদাতের পর হামাসের যোদ্ধারা উনাকে স্মরণ করছে )



Leave a Comment:

Login to comment